জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল এবং ইমার্জেন্সি পিল আসলে কী? কারা খাবেন?

জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল / খাবার বড়ি (পিল), গর্ভনিরোধক খাবার বড়ি/পিল নিরাপদ ও কার্যকর জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি । বাংলাদেশে খাবার বড়ি সর্বাধিক ব্যবহৃত পদ্ধতি । বর্তমানে প্রচলিত মিশ্র খাবার বড়ির উপাদান হোল ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টোরেন হরমোন । মূলত ইস্ট্রোজেন হরমোনের পরিমাণের উপর ভিত্তি করে খাবার বড়ির প্রকার নির্ণয় করা হয় । এছাড়া শুধুমাত্র প্রজেস্টোরেন সমৃদ্ধ মিনিপিলও কার্যকর গর্ভনিরোধক বড়ি হিসাবে ব্যবহৃত ।

জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল

জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল আসলে কী?

এগুলো মূলত ইস্ট্রোজেন-প্রজেস্টেরন হরমোনের বড়ি। ওইসব বড়ি খেলে ওভিউলেশন বা ডিম্বাণু নির্গমন হয় না। ফলে গর্ভসঞ্চারের সম্ভাবনাও থাকে না। সাধারণত দুই ধরনের জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল বাজারে পাওয়া যায়। একটিতে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন থাকে এবং অপরটিতে শুধু প্রোজেস্টেরন থাকে। দুটিই গর্ভসঞ্চার রোধে সমান কার্যকরী। কিন্তু প্রথম পিলটি কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

এই দুই ধরণের পিল পিরিয়ডের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ এবং ব্যথা কমায়। যেসকল বড়িতে কেবল প্রোজেস্টেরন থাকে, সেগুলো একটি নির্দিষ্ট সময়ে খেতে হয়। তবে জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল খেতে শুরু করলেও প্রথম সপ্তাহে যৌন মিলনের সময় অন্য কোনো কার্যকরী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি (যেমন কনডম) ব্যবহার করা উচিত। কারণ ওই পিলের প্রভাব কার্যকর হতে কিছুটা সময় লেগে যায়। অবশ্যই মনে রাখবেন, জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল বা বড়ি খাওয়া শুরু আগে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করা জরুরি।

ইমার্জেন্সি জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল: জন্মনিয়ন্ত্রণ পিলের সঙ্গে অনেকে ইমার্জেন্সি কন্ট্রাসেপটিভ পিলকে গুলিয়ে ফেলেন। এটা কিন্তু একেবারেই ভুল। অনাকাঙ্খিত গর্ভধারণ রোধে বিজ্ঞানের আশীর্বাদ ইমার্জেন্সি কন্ট্রাসেপটিভ পিল। বাংলাদেশের বাজারে এখন অনেক কম্পানির ইমার্জেন্সি কনট্রাসেপটিভ পিল পাওয়া যায়। যেগুলো যৌন মিলনের ২ দিন থেকে ৫ দিন পর্যন্ত ব্যবহার উপযোগী।

অসুরক্ষিত যৌন মিলনের পর অনেকেই ইমার্জেন্সি পিলের সাহায্য নিয়ে থাকেন। আবার নিয়মিত বার্থ কন্ট্রোল পিল খেতে ভুলে গেলেও এটা খাওয়া যায়। তবে কোনোভাবেই ইমার্জেন্সি পিলকে নিয়মিত বার্থ কন্ট্রোল পিল হিসেবে ব্যবহার করা উচিত নয়। শুধু জরুরি মুহূর্তেই এটা ব্যবহার করা যাবে। তাছাড়া ইমার্জেন্সি পিল গর্ভপাত ঘটায় না। সুতরাং গর্ভবতী হয়ে গেলে এটা খেয়ে কোনো লাভ নেই। তিন-চার মাসে এক-দুইবারের বেশি ইমার্জেন্সি পিল খাওয়া উচিত নয়।

উল্লেখ্য, যারা এখনও বাচ্চা নেননি তাদের দুই ধরনের পিলই বেশিদিন ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করা হয়। তাছাড়া যৌনমিলনের সময় কনডম ব্যবহারই বিশ্বব্যপী সেরা জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি হিসেবে পরিচিত। আজকাল পুরুষের পাশাপাশি মেয়েদের কনডমও সহজলভ্য হয়ে উঠছে।

আরো পড়ুন  স্বামী সহ’বাসের জন্য ডাকলে স্ত্রী সহবাসে বাধা দিতে পারবে কি? জানুন ইসলামের বিধান

গর্ভধারণ প্রতিরোধে খাবার বড়ি কিভাবে কাজ করে

সারভিক্সের শ্লেষাকে ঘন করে শুক্রকীটকে জরায়ুতে প্রবেশে বাধা দেয় ।
ডিম্বস্ফুটনে বাধা দেয় । স্বাভাবিক মাসিক চক্রের মাঝামাঝি সময়ে লিউটিনাইজিং হরমোন হঠাৎ বেড়ে যাবার ফলে ডিম্বস্ফুটন হয় । খাবার বড়ি লিউটিনাইজিং হরমোন হঠাৎ বেড়ে যাওয়াকে প্রতিহত করে ডিম্বস্ফুটন হতে দেয় না ।
ডিম্ববাহী নালীর স্বাভাবিক নড়াচড়ার গতি কমিয়ে দেয়, ফলে শুক্রকীটের গতিও কমে যায় ।
ডিম্বের কাছে পৌছাতে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সময় লাগে বলে শুক্রকীট দুর্বল হয়ে পড়ে বা মারা যায় ।
জরায়ুর ভিতরের ঝিল্লির বেড়ে যাওয়া রোধ করে, ফলে নিষিক্ত ডিম্ব জরায়ুতে গ্রথিত হবার মত কোনো পরিবেশ না পেয়ে গ্রথিত হতে পারে না ।

মিশ্র খাবার বড়ি প্রথম শুরু করার নিয়ম

বাংলাদেশে প্রায় সকল মিশ্র খাবার বড়ির প্যাকেটে ২১টি সাদা জন্মনিরোধক বড়ি এবং ৭ টি খয়েরি বড়ি (আয়রন বড়ি) থাকে । যেসব প্যাকেটে ২১টি বা ২২টি বড়ি থাকে সেক্ষেত্রে সব শেষ হয়ে গেলে মাসিকের জন্য অপেক্ষা করতে হবে । মাসিক শুরু হলে মাসিকের প্রথম দিন থেকে আবার নতুন প্যাকেটের বড়ি খাওয়া শুরু করতে হবে । যদি মাসিক না হয় এবং গ্রহীতা নিশ্চিত থাকেন যে, কোনো বড়ি খেতে ভুল হয় নি তবে শেষ বড়ি খাওয়ার ৭ দিন পরে নতুন পাতা থেকে বড়ি খেতে শুরু করবেন । এছাড়া-

ডিম্বস্ফুটন সঠিকভাবে প্রতিরোধ করার জন্য মাসিকের প্রথম দিন থেকে শুরু করা উচিত ।
মহিলা যদি নিশ্চিত হন যে, তিনি গর্ভবতী নন তবে প্রয়োজনে যে কোনো দিন থেকে শুরু করতে পারেন ।
মিনিপিল

শুধুমাত্র প্রজেস্টোরেন দিয়ে যে জন্মবিরতিকরন খাবার বড়ি বা পিল তৈরি হয় তাই মিনিপিল । মিনিপিল শতকরা ৯৭- ৯৮ ভাগ কার্যকর । মিনিপিল খাওয়ার নিয়ম

প্রতিদিন একই সময়ে একটি করে বড়ি খেতে হবে ।
একটি প্যাকেটের সবগুলো বড়ি খাওয়া হয়ে গেলে পরদিনই নতুন আরেকটি পাতা থেকে শুরু করতে হবে । দুই প্যাকেটের মাঝে বিরতি দেয়া যাবে না ।

মিনিপিল প্রথম শুরু করার সময়

মাসিক শুরুর ৫দিনের মধ্যে ।
যারা বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন, তারা বাচ্চার জন্মের ৬ সপ্তাহ পর থেকে শুরু করতে পারেন ।
যারা বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন না, তারা যে কোনো সময় শুরু করতে পারেন, মাসিক হোক বা না হোক।
যদি বাচ্চার জন্মের ৪ সপ্তাহ পর থেকে খাওয়া শুরু করেন তবে তাকে নিশ্চিত হতে হবে যে, তিনি গর্ভবতী নন ।
বড়ি খেতে ভুলে গেলে করণীয়

যদি একদিন বড়ি খেতে ভুলে যান তাহলে যখনই মনে পড়বে তখনই একটি বড়ি খাবেন এবং ঐদিনের বড়িটি যথাসময়ে খাবেন ।
যদি পরপর দুইদিন বড়ি খেতে ভুলে যান তাহলে মনে পড়ার সাথে সাথে দুইটি বড়ি খাবেন । পাতার বাকি বড়ি নির্দিষ্ট সময়ে প্রতিদিন একটি করে খাবেন এবং পরবর্তী মাসিক না হওয়া পর্যন্ত কনডম ব্যবহার করবেন বা সহবাস থেকে বিরত থাকবেন ।
যদি পরপর তিনদিন বড়ি খেতে ভুলে যান তবে ঐ পাতা থেকে আর বড়ি খাবেন না এবং পরবর্তী মাসিকের আগ পর্যন্ত কনডম ব্যবহার করবেন বা সহবাস থেকে বিরত থাকবেন ।
যদি খয়েরি বড়ি (২৮টি বড়ির প্যাকেট) খেতে ভুলে যান তবে ঐ পাতা থেকে আর খয়েরি বড়ি খাবেন না এবং নতুন পাতা হতে রোজ একটি করে সাদা বড়ি খেতে শুরু করতে হবে ।
কোনো কারণে স্বামী সাময়িকভাবে বাড়িতে না থাকলে বড়ি খাওয়া বাদ দেয়া যাবে না ।
খাবার বড়ির সুবিধা

সঠিক ভাবে খেলে এটি অত্যন্ত কার্যকরী ও নিরাপদ ।
প্রজননক্ষম সকল বয়সী মহিলা / নারী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি হিসাবে খাবার বড়ি ব্যবহার করতে পারেন ।
এটি একটি অস্থায়ী পদ্ধতি, যে কোনো সময় বড়ি ছেড়ে দিয়ে অন্য পদ্ধতি ব্যবহার করা যায় বা গর্ভধারণ করা যায় ।
জরুরি গর্ভনিরোধক হিসাবেও ব্যবহার করা যায় ।
খাবার বড়ির অন্যান্য স্বাস্থ্য সুবিধা

জরায়ুর বাইরে গর্ভধারণের ঝুকি কমায় ।
মাসিকের সময় জরায়ুর মোচড়ানো ব্যথা কমায় ।
মাসিকের স্রাবের সময়কাল ও পরিমাণ কমায় এবং রক্তসল্পতা দূর করতে সাহায্য করে ।
মাসিক চক্রকে নিয়মিত করে ।
ডিম্বাশয়ে সিস্ট হওয়ার ও ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায় ।
স্তনের ব্যাধির সম্ভাবনা কমায় ।
গনোরিয়াজনিত পিআইডির মাত্রা হ্রাস করে।
ব্রণ, অবাঞ্ছিত লোম ওঠা কমায় ।
মাসিক পূর্ববর্তী উপসর্গ কমায় ।
খাবার বড়ি গ্রহণের অসুবিধা

প্রতিদিন খেতে হয় ।
যৌন রোগ প্রতিরোধ করে না ।
মাসিক স্রাব বন্ধ থাকতে পারে।
যোনিপথের পিচ্ছিলতা কমে যেতে পারে ।
বুকের দুধ কমে যেতে পারে ।
বিমর্ষতা দেখা দিতে পারে ।
খাবার বড়ির পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া

খাবার বড়ি ব্যবহারের প্রথম দিকে (৩ থেকে ৪ মাস) ছোটখাটো পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে । যেমন-

আরো পড়ুন  কখন গোসল করা ফরজ, কীভাবে করতে হয়

উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিতে পারে
স্তন ভারী বোধ হওয়া এবং স্তন স্পর্শ কালে ব্যথার অনুভুতি
দুই মাসিকের মধ্যবর্তী সময়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্তস্রাব
বিমর্ষতা দেখা দিতে পারে
বমি বমি ভাব
মাথা ধরা
মুখে ব্রন
ওজন বৃদ্ধি
যে সমস্ত মহিলা মায়োকার্ডিয়াল ইনফারকশন, স্ট্রোক ইত্যাদি-এ আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি আছে, তাদের ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে দেয়।
ক্লোয়াজম বা গর্ভবস্থার মতো মুখের ত্বকের রঙের পরিবর্তন হতে পারে ।
শিরার রক্ত জমাট বেধে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় । তাই অতীতে বা বর্তমানে যাদের এই সমস্যা হয়েছে, তারা ইস্ট্রোজেন সমৃদ্ধ মিশ্র খাবার বড়ি খেতে পারবেন না ।
খাবার বড়ি কোথায় পাওয়া যায়

আমাদের দেশে সরকারি পর্যায় মাঠকর্মী, কমিউনিটি ক্লিনিক, স্যাটেলাইট ক্লিনিক, ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র, জেলা সদর হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং স্বীকৃত এনজিও/ বেসরকারি ক্লিনিক, ফার্মেসিতে খাবার বড়ি পাওয়া যায় ।

বিভিন্ন ব্র্যান্ডের জন্মবিরতিকরণ খাবার বড়ি

সরকারি পিল সুখী বিনামুল্য মাঠকর্মীর কাছ থেকে, কমিউনিটি ক্লিনিক, স্যাটেলাইট ক্লিনিক, ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে পাওয়া যায় । এসমসি ব্র্যান্ডের পিল নরেট-২৮, ফেমিকন, ফেমিপিল, মাইপিল, ওভাকন গোল্ড, এবং শুধুমাত্র প্রজেস্টোরেন সমৃদ্ধ মিনিপিল মিনিকন নামে যে কোনো ফার্মেসিতে পাওয়া যায় ।

কনডম ছাড়াও জন্ম নিয়ন্ত্রণের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলো জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল। বাধাহীনভাবে যৌন মিলন করার জন্য অনেক নারীই জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল বা খাবার বড়ি ব্যবহার করে থাকেন। তবে এই পিল বা বড়ি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা অনেকেরই নেই। জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল ব্যবহার করলে অবাঞ্চিত প্রেগন্যান্সির সম্ভাবনা কমে যায়। তার ফলে নারীদের ভিতরে গর্ভবতী হওয়ার ভয় আর কাজ করে না। এবং সেক্স লাইফও রঙিন হয়।

জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল কারা খাবেন

দীর্ঘ মেয়াদে সন্তান না চাইলে কনডম, জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি, আইইউডি বা ইনজেকশনের মতো পদ্ধতি নেওয়াই ভালো। তবে আকস্মিক কিছু পরিস্থিতিতে এই ইমার্জেন্সি পিল সেবনের কথা বিবেচনা করা যায়, যেমন জন্মনিরোধক বা কনডম ছিঁড়ে গেলে, পর পর দুদিন জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি খেতে ভুলে গেলে, ডায়াফ্রাম বা সারভাইক্যাল ক্যাপের স্থানচ্যুতি হলে বা সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় শারীরিক মিলনের পর।

জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল কারা খাবেন না

যাঁরা এর মধ্যেই গর্ভধারণ করেছেন, তাঁরা সময় ১২০ ঘণ্টা পার হয়ে গেলে বা খুব ঘন ঘন খাবেন না।

ওভার দ্য কাউন্টার বা জরুরি ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হলেও প্রতিটি ওষুধের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে, যা একেক মানুষের ক্ষেত্রে একেক রকম হতে পারে। তাই পরিকল্পিত গর্ভধারণ করতে চাইলে চিকিৎসকের পরামর্শে আপনার জন্য উপযুক্ত কোনো পদ্ধতি গ্রহণ করাই ভালো। এতে বারবার এ ধরনের পিল সেবনের দরকার হয় না।

Leave a Reply

Your email address will not be published.